“ঈশ্বরের পবিত্র ইচ্ছার স্বর্গ থেকে ধর্মের উদ্দেশ্য যেরকম উন্মোচিত হয়েছে, তা হোলো, পৃথিবীর মানুষদের মধ্যে একতা ও সংগতি স্থাপন করা, একে মতানৈক্য এবং দ্বন্দের কারণ হতে দিও না।”


বাহাউল্লাহ

ভারতীয় উপ-মহাদেশ ধর্মের শুরু থেকেই বাহাই ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। উপ-মহাদেশ থেকে সাইদ-ই-হিন্দী ছিলেন বাবের অনুগামী হওয়া প্রথম ব্যক্তি। ভারত থেকে তারমতো অনেকে ছিলেন যারা তাঁর স্বল্প-জীবনকালে বাব-এর দিব্য লক্ষ্যস্থল শনাক্ত করেছিলেন। বাব-এর মন্ত্রিসভায়, তাঁর শিক্ষাবলীর আলো ভারতের গ্রাম ও শহরগুলিতে পৌঁছেছিলো, যেমন বম্বে (এখন মুম্বাই), হায়দ্রাবাদ, জৌনপুর, রামপুর এবং পালামপুরে।

জামাল এফেন্দী, একজন পার্সিয়ান অভিজাত মানুষ, ১৮৭২ সালে যিনি সম্পূর্নভাবে এই উপ-মহাদেশে ভ্রমন করেছিলেন। তার এই যাত্রা তাকে উত্তরে রামপুর এবং লখনৌ, পুর্বে কলকাতা এবং রেঙ্গুন, পশ্চিমে বরোদা থেকে মুম্বাই এবং সবশেষে দক্ষিণে চেন্নাই থেকে কলম্বো নিয়ে গিয়েছিলো। তিনি বাহাউল্লাহর একতা ও সৌহার্দের শিক্ষাবলী যাদের সঙ্গে দেখা হয়েছিলো, নবাবসমূহ থেকে রাজকুমারী এবং উপনিবেশীয় প্রশাসকবর্গ থেকে সাধারণ লোকমানুষ পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলেন বর্তমানে থাকা সামাজিক রীতির বিপরীতে সামাজিক শ্রেণী-বিভাগ, জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের সঙ্গে মিশেছিলেন।

শতাব্দীর আবর্তনের পর, বম্বে, দিল্লী, পুণে এবং হায়দ্রাবাদে ছোটো ছোটো বাহাই সমাজ গড়ে উঠেছিলো। উপ-মহাদেশের বাড়তে থাকা বাহাই সমাজের বিষয়গুলির তত্ত্বাবধানের জন্য প্রথম নির্বাচিত জাতীয় প্রশাসনিক সংস্থা গড়ে উঠেছিলো ১৯২৩ সালে।

বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে যখন বাহাই সমাজ আকারে ও শক্তিতে বৃদ্ধি পেলো, বাহাউল্লাহর শিক্ষাবলী ক্রমশ নেতৃবৃন্দের এবং চিন্তাশীল মানুষজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। মহাত্মা গান্ধী বেশ কিছু বাহাইদের সঙ্গে মত বিনিময়ের পর ঘোষণা করলেনঃ “বাহাই ধর্ম মানব জাতির কাছে একটি সান্ত্বনা।” একইভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যিনি অনেক প্রতিষ্ঠিত বাহাইদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন, বাহাউল্লাহকে “এশিয়া থেকে উঠে আসা নবীনতম অবতার” এবং যার “বার্তা সভ্যতার অগ্রগতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছিলেন।”

১৯৬০-এবং ’৭০ সালে, বাহাউল্লাহর বার্তা ভারতের সাধারণ মানুষদের মধ্যে বিস্তারলাভ করতে শুরু করলো। ধর্মের শিক্ষাগুলির মূল্যবোধের স্বীকৃতি প্রায়ই ছিলো মানুষের মনে স্বতঃস্ফুর্ত। যারা এর মুখোমুখি হয়েছিলেন, শত সহস্র ভারতবাসী এই শিক্ষার মধ্যে বসুধৈব কুটুম্বকমের দীর্ঘ-প্রতীক্ষিত আকাংখার পরিপূর্নতা খুঁজে পেলেন। তারা এই আদর্শগুলির রূপায়নে নতুন উদ্দীপনা যেইভাবে খুঁজে পেলেন যা বর্তমান যুগের সমাজের জরুরী চাহিদাগুলির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ন।

সহস্রাধিক কঠোর প্রচেষ্টায় তাদের সমাজগুলির মুখোমুখি থাকা চ্যালেঞ্জগুলিতে এগুলি প্রয়োগ করা শুরু করলেন।শতাধিক গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত স্থানীয় বাহাই প্রশাসনিক সংস্থাগুলি সারা ভারত জুড়ে নির্বাচিত হোলো এবং তারা তাদের অঞ্চলের প্রয়োজনগুলির কাজে আসতে শুরু করলেন। শিশুদের নৈতিক শিক্ষা একটি নতুন তাগিদ অনুভব করলো এবং সারা ভারত জুড়ে শিক্ষাগত প্রচেষ্টাগুলি গ্রামগুলিতে শুরু হোলো। ১৯৮০ সালের মধ্যে, শত শত গ্রামীণ স্কুল যা বাহাই শিক্ষায় অনুপ্রাণিত এবং কৃ্ষি, বৃত্তিমূলক এবং শিক্ষক প্রশিক্ষন, স্বাক্ষরতা, পারিপার্শ্বিক দায়িত্ব, মহিলাদের সক্ষম করা, স্বাস্থ্য ইত্যাদির বাস্তবরূপ সামনে উঠে এলো।

নতুন দিল্লিতে উপাসনা গৃহের নির্মান যা ছিলো মানব হৃদয় এবং সমাজের জন্য বাহাউল্লাহ রূপান্তরের যে চিন্তা মনশ্চক্ষে দেখেছিলেন তার স্বীকৃত প্রতীক। পদ্ম আকারের নকশা প্রত্যয় প্রতিফলন করে যে, একটি নতুন আরও সুন্দর বিশ্ব অত্যন্ত শোচনীয় পরিস্থিতিতে প্রস্ফুটিত হতে পারে। এটি একতারও প্রতীক সূচীত করে। ১৯৮৬ সালে এর উদ্বোধনের পর থেকে সকল ধর্মের দশ হাজার মানুষ প্রতিদিন এর গম্বুজের তলায় এসে একজন সর্বজনীন সৃষ্টি কর্তার উদ্দেশ্যে নিঃশব্দ উপাসনা করেন।

যখন ভারতে বাহাই সমাজ আকারে এবং ক্ষমতায় বেড়ে উঠছিলো, তারা সমাজ জীবনে আরও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করা শুরু করলেন। জাতীয় পরিসরে, বাহাই অবদানগুলি উন্নত চিন্তাধারা যেমন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, নারী-পুরুষের সমানাধিকার, শিক্ষা, শাসন ব্যবস্থা এবং উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়গুলির উচ্চ মূল্যায়ন করা হোলো।

আজকে, ভারতে বাহাইদের সংখ্যা কুড়ি লক্ষেরও বেশী। তারা তাদের রাষ্ট্রের কাজে স্বদেশবাসীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে সমাজ গঠনে নিবেদিত যা একতা, ন্যায়পরতা রূপদান করছে, যা সমস্ত ধরণের পূর্ব-সংস্কার মুক্ত যেখানে মহিলা ও পুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমভাবাপন্ন হয়ে সমাজে কাজ করছেন, যেখানে শিশুরা এবং যুবারা সবথেকে ভালো আধ্যাত্মিক এবং বিজ্ঞানসম্মত উভয় শিক্ষালাভ করছে, যেখানে সমাজের ভক্তিমূলক জীবন ক্ষতিকারক সামাজিক শক্তিগুলির বিরুদ্ধে সুরক্ষা প্রদান করছে।